Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

এক নজরে টাঙ্গাইল

ক্র: নং

বিবরণ

বিস্তারিত

০১

টাঙ্গাইল জেলা সৃষ্টির ইতিহাস

বর্তমান টাঙ্গাইল জেলা অতীত যমুনা নদীর বুকে নতুন জেগে ওঠা চর এলাকার সমষ্টি।এখানে ছোট্ট ছোট্ট জনগোষ্ঠী বসবাস শুরু করে যার অধিকাংশই ছিল পাশ্ববর্তী উত্তরবঙ্গের অর্থাৎ যমুনার পশ্চিম পাড়ের অধিবাসী। অতীত কাল থেকেই বহু ভাঙ্গাগড়া ও রাজনৈতিক দখল-বেদখল, চড়াই উৎরাই পেরিয়ে যে এলাকা আজ টাঙ্গাইল জেলা বলে পরিচিত লাভ করেছে, টাঙ্গাইল হিসাবে তার গঠন ও স্বতন্ত্র পরিচয় ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পাওয়া যায় না। অর্থাৎ এই ভূমিতে জন বসতি পুরাতন হলেও টাঙ্গাইল নামটি সাম্প্রতিক। বরং এই অঞ্চল আটিয়া পরগণার অংশ হিসেবে মোগল আমল থেকে পরিচিত। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে কাসিম বাংলার নবাব হওয়ার পর খাজনা আদায়ের জন্য যে ভূমি বন্দোবস্ত করেন তাতে আটিয়া, কাগমারী, বড়বাজু হোসেনশাহী ইত্যাদি পরগণার নাম পাওয়া যায়- টাঙ্গাইলের নাম পাওয়া যায় না। ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত রেনেলের মানচিত্রে টাঙ্গাইলের উল্লেখ নেই। পলাশী যুদ্ধের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ক্ষমতা গ্রহণের পর এদেশে সর্বপ্রথম ভূমি জরিপ হয় ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে সেখানেও টাঙ্গাইলের উল্লেখ নেই। ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে শাসনকার্যের সুবিধার জন্য জামালপুর মহকুমা সৃষ্টি হয়। বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলাকে দু’টি বিভাগে বিভক্ত করা হয়। ১। সদর বিভাগ, ২। জামালপুর বিভাগ। সদর বিভাগের অধীনে নাসিরাবাদ, গাবতলী, মধুপুর, নেত্রকোণা, ঘোষগাঁও, ফতেপুর, গফরগাঁও, মাদারগঞ্জ, নিকলি ও বাজিতপুর থানা সমূহ এবং জামালপুর বিভাগের অধীনে শেরপুর, হাজিগঞ্জ ও পিংনা থানা সমূহ রাখা হয়। আটিয়া পরগণার অঞ্চল সমূহ তখন ঢাকা জেলার অন্তর্ভৃক্ত ছিল। ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় ভূমি জরিপের সময়েও টাঙ্গাইলের উল্লেখ পাওয়া যায় না। রেনেলের মানচিত্রে আটিয়া পরগণার উল্লেখ ছিল। তখন বর্তমান টাঙ্গাইলের অধিকাংশ অঞ্চল আটিয়া পরগণার অধীনে ছিল। আঠার ও ঊনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত আটিয়া নামে পরিচিত অঞ্চলই বর্ধিত হয়ে বর্তমান টাঙ্গাইলের রূপলাভ করেছে। এ থেকে বুঝা যায় টাঙ্গাইলের সাবেকি নাম আটিয়া বললে খুব বেশী ভূল হবে না। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে সরকার পারদিঘুলিয়া মৌজায় টানআইল (পরে নাম রূপান্তর হয়ে টাঙ্গাইল হয়) থানার প্রত্তন করে। করটিয়ার মুসলিম জমিদারও বরাবর ইংরেজ বিদ্বেষী ছিল বিধায় আটিয়া পরগণাতেও নতুন থানা বা চৌকির স্থান নির্দিষ্ট হয়নি। যদিও প্রশাসনিক দিক থেকে সেটাই ছিল সর্বোত্তম। যাই হোক নতুন থানাকেই মহকুমা ঘোষণা দিয়ে ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে মোমেনশাহীর সঙ্গে জুড়ে দেবার কারণটাও অনেকেই টাঙ্গাইলের স্বাতন্ত্র্যতাকে বিনষ্ট করার একটি সুক্ষ্ণ চক্রান্ত বলে মনে করেছেন। অনেকেই আবার এও মনে করেন যে, টাঙ্গাইলের শিক্ষা সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক সক্রিয়তায় অংশীদারিত্ব দাবি করার একটা পরোক্ষ প্রচেষ্টা হিসেবে বিশেষ একটি গোষ্ঠি ইংরেজদের সহযোগিতায় এমনটি করিয়ে ছিলেন। ময়মনসিংহ জেলায় অন্তর্ভূক্তির পর থেকেই টাঙ্গাইল বাসি নিজেদের স্বাতন্ত্র্যতা রক্ষার প্রয়োজনে টাঙ্গাইলকে ময়মনসিংহের আওতা থেকে মুক্ত করে পৃথক জেলার দাবী করে আসতে থাকেন।


টাঙ্গাইল মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করার জন্য বহু সংগ্রাম করতে হয়েছে। এই প্রচেষ্টা বৃটিশ আমল থেকে পাকিস্তান আমলের শেষ পর্যায় ছিলো।অবিভক্ত বঙ্গদেশে ময়মনসিংহ জেলা ছিল সবচেয়ে বড় জেলা। ময়মনসিংহে থেকে জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল শাসন ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করা ছিলো কঠিন কাজ। তাই স্বভাবত কারণেই টাঙ্গাইল মহকুমাকে জেলা উন্নীত করার বার বার দাবী উঠছে। প্রশাসনের কাছ থেকে আশ্বাস পাওয়ার পরও টাঙ্গাইল জেলায় উন্নীত হতে পারেনি। কারণ যখনই জেলা প্রতিষ্ঠান দাবী তোলা হয়েছে তখনই রাজনৈতিক কারণে তা বাস্তবায়িত হতে পারেনি। একদা ময়মনসিংহ জেলাই টাঙ্গাইল অঞ্চলের গোপালপুর থানার সূবর্ণ খালীতে স্থানান্তর হতে চেয়েছিল। কারণ সূবর্ণখালী সেই সময়ে ময়মনসিংহ জেলার স্বাস্থ্যকর স্থান ছিল। সুর্বণখালী যে তখন স্বাস্থ্যকর স্থান ছিল তার বিবরণ কিছুটা পাওয়া যায় ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের প্রকাশিত ময়মনসিংহ গেজেটিয়ারে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থেকে বাঁচার জন্য ময়মনসিংহের তৎকালীন সিভিল সার্জন ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলা সদর সুর্বণখালীতে স্থানান্তরের পরমর্শ রেখেছিলেন। সরকারের নিকট গেজেটিয়ারে উল্লেখ আছে - The towns of Maymenshingh are not sufficient impertinence to merit special attention in this chapter. In 1869 civil surgeon recommended the transfer of the head quarters of the district to Seaborne Khaki or Jamalpur. ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে Sir Andrew Fraser ময়মনসিংহ জেলা বিভক্ত করে পৃথক জেলা প্রতিষ্ঠার বিষয়টি আবার আলোচনায় নিয়ে আসেন। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গ ভঙ্গ হলেও বিষয়টি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলতে থাকে। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব বঙ্গ ও আসাম সরকার এক প্রজ্ঞাপণের মাধ্যমে ময়মনসিংহ জেলা সদরের দুই প্রান্তে পৃথক দু’টি জেলা সদর স্থাপন করে ময়মনসিংহকে দুটি পৃথক জেলায় রূপান্তর করার বিষয়ে জনমত জরিপের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। প্রস্তাবটি বিরোধিতার সম্মুখীন হলে টাঙ্গাইল জামালপুর মহকুমা নিয়ে পৃথক একটি জেলা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহণ পূর্বক জনমত জরিপের ব্যবস্থা করেন। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে এ বিষয়ে ময়মনসিংহ জেলা শহরে একটি বড় জনসভাও অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ধনবাড়ির অনারেবল নবাব স্যার নওয়ার আলী চৌধুরী সি.আই.ই সাহেব ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে টাঙ্গাইল মহকুমার কতিপয় জমিদার ও বিশিষ্ট ব্যাক্তিকে নিয়ে ধনবাড়িতে এক সভার আয়োজন করেছিলেন। সেই সভাতেই প্রথম সুবৃহৎ মোমেনশাহী জেলাকে বিভক্ত করার দাবী উত্থাপিত হয়েছিল। অনারেবল নবাব স্যার নওয়াব আলী চৌধুরী সাহেব ছিলেন ইংরেজ লাট সাহেবের কাউন্সিলর। তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়ে ছিলেন প্রভাবশালী জমিদার স্যার আবদুল হালীম গজনবী সাহেব। তিনি ছিলেন রেলওয়ের বোর্ডের সদস্য। তাদের মিলিত প্রচেষ্টায় সমগ্র টাঙ্গাইল মহকুমা ও জামালপুর মহকুমার কিয়দংশ নিয়ে একটা স্বতন্ত্র জেলা প্রতিষ্ঠার দাবী পেশ করা হয়েছিল। দাবী করা হয়েছিল প্রস্তাবিত জেলার সদর স্থাপনের জন্য ধনবাড়িকে মনোনীত করা হোক। কেবল তাই নয় ধনবাড়ি হয়ে টুঙ্গি-টাঙ্গাইল-জামালপুর একটা নতুন রেল পথ স্থাপনেরও পরিকল্পনা পেশ করা হয়েছিল ইংরেজ সরকারের কাছে। ময়মনসিংহ জেলা বিভক্তি করণের বিষয়টি সাধারণ জনগণের মনে তেমন প্রক্রিয়া সৃষ্টি করেনি এবং আগ্রহও দেখায়নি। কারণ জনগণ থেকে প্রশাসন ও প্রশাসনিক কর্মকর্তার অবস্থান ছিল অনেক দূরত্বে। তারা প্রশাসনিক সুযোগ সুবিধা থেকেও বরাবর বঞ্চিত ছিল। প্রস্তাবনার পক্ষে বা বিপক্ষে তাদের তেমন অবন্থান ছিল না। তবে শিক্ষিত সুধিমহল বিশেষতঃ উকিল, মোক্তার, ব্যবসায়ী, জমিদার, উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পেশাজীবি লোকজন জেলা বিভাজনের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব সহকারে বিচার বিশ্লেষণ করেছেন। ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত স্বার্থ জরিত থাকার কারণে তারা ময়মনসিংহ জেলা সদরের বাইরে অন্য কোথায়ও জেলা সদর স্থাপনের বিরোধিতা করেছেন। প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট কমিটির রিপোর্টে উল্লেখ আছে- The protests appeared to come almost entirely from the pleader class. These are supported by the numerous classes of touts, hotel keepers and other persons nourished by litigation. A small number of zaminders, whose house were in Mayenshing and lands in some outlying part of the district, were also very naturally impressed by the inconvenience that would be caused to them selves. This person also put for word the argument, which appealed to a winder section- That the importance of the district ant of it’s local bodies, official & non official, would be diminished, while such head quarters institutions as schools, colleges, water, works, dispensaries & like would suffer... বাংলার বিভিন্ন জেলা সমূহে বিদ্যমান অসুবিধা ও জটিল পরিস্থিতি যাচাই করার জন্য সরকার ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের ২৫ অক্টোবর ৬ সদস্য বিশিষ্ট Bengal District Administration committee গঠন করেন। কমিটির মেয়াদকাল ছিল ১৯১৩-১৪ খ্রিস্টাব্দ। মিঃ ই.ভি লিভিঞ্জ ছিলেন কমিটির সভাপতি এবং সদস্য সচিব ছিলেন মিঃ সি.ই.লো। কমিটির সম্মানিত সদস্য ছিলেন মিঃ এইচ. ভি. লোভেট, মিঃ এন.ডি বিটসন বেল, মিঃ কে.সি.দে এবং মিঃ ই.এন. ব্লান্ডি। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ নভেম্বর তারিখে কমিটি কাজ শুরু করেন। উক্ত কমিটি সরকারের বিভিন্ন দলিল দস্তাবেজ, বিগত কমিটি সমূহের রিপোর্ট পর্যালোচনার পাশা পাশি বিভিন্ন জেলায় সরোজমিনে পরিদর্শন ও সুধিমহলের সঙ্গে মত বিনিময়ের মাধ্যমে প্রকৃত সমস্যা চিহ্নিত করে নিজস্ব সুপারিশ বা প্রস্তাবনা সরকারের নিকট পেশ করেন। তাদের সুপারিশ মালায় ময়মনসিংহ জেলা বিভিক্ত করে তিনটি পৃথক জেলা প্রতিষ্ঠা (ময়মনসিংহ, গোপালপুর ও কিশোরগঞ্জ) এবং বিদ্যমান পাঁচটি মহকুমার স্থলে নয়টি মহকুমার স্থাপনের পরিকল্পনা ছিল। প্রস্তাবিত গোপালপুর জেলার রূপরেখা ও কাঠামোঃ নালিতাবাড়ি থানা ব্যতীত সমগ্র জামালপুর এবং টাঙ্গাইল মহকুমা নিয়ে প্রস্তাবিত গোপালপুর জেলা গঠিত হবে। জেলা সদরের জন্য স্থান নির্বাচন প্রসঙ্গে টাঙ্গাইল ও জামালপুর শহরের অধিবাসীদের মধ্যে উত্তেজনা ও উৎকণ্ঠা বিরাজমান ছিল। উভয়ের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও ছিল লক্ষনীয়। জামালপুর ও টাঙ্গাইলের মধ্যে টাঙ্গাইল মহকুমা ছিল বড় ও গুরুত্বপূর্ণ। তবে টাঙ্গাইল সদর শহর ছিল খুবই অস্বাস্থ্যকর। টাঙ্গাইল অথবা জামালপুর শহরের যে কোন একটিকে প্রস্তাবিত জেলা হিসেবে বেছে নিলে তা জেলার একপ্রান্তে অবস্থিত থাকবে। সেজন্য প্রশাসনিক যে অসুবিধা দেখা দিবে তা মোকাবেলার জন্য আবারও নতুন মহকুমা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিবে। এসমস্ত অসুবিধা ও প্রতিবন্ধকতার কথা বিবেচনা করে কমিটি টাঙ্গাইল ও জামালপুর জেলার মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত গোপালপুর থানাতে জেলা সদর স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। প্রস্তাবিত জামালপুর-টাঙ্গাইল এবং সুর্বণখালী-ময়মনসিংহের রেলপথের সংযোগস্থলের নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকর একটি জায়গাতে জেলা সদর নির্মাণের স্থান বাছাই করা হয়। প্রস্তাবিত গোপালপুর জেলায় মহকুমা ছিল তিনটিঃ ক) সদর মহকুমা, খ) জামালপুর মহকুমা, গ) টাঙ্গাইল মহকুমা। ক) সদর মহকুমাঃ সরিষাবাড়ি, গোপালপুর, কালিহাতী ও ঘাটাইল থানা নিয়ে গঠিত। এর আয়তন ৬১৬ বর্গমাইল। লোক সংখ্যা ৫,৫৪,৩১৫ জন। গ্রাম- ৮৯ টি। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে উল্লেখিত থানা সমূহে পুলিশ কেসের সংখ্যা ছিল ৬৬১ টি। খ) জামালপুর মহকুমাঃ জামালপুর-মেলান্দ, শেরপুর, দেওয়ানগঞ্জ ও মাদারগঞ্জ থানা সমন্বয়ে গঠিত। এর আয়তন ৯৪৮ বর্গ মাইল। লোক সংখ্যা ৬,৮৮,৭৫৩ জন। গ্রাম- ৯৬ টি। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে থানা সমূহে নথিভূক্ত পুলিশ কেস ছিল ৬৫২ টি। গ) টাঙ্গাইল মহকুমাঃ টাঙ্গাইল, বাসাইল, মির্জাপুর ও নাগরপুর থানা সমন্বয়ে গঠিত। এর আয়তন ৪৪৬ বর্গ মাইল। লোক সংখ্যা ৪,৯৫,৪৫৭ জন। গ্রাম- ৮৭ টি। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে এসব থানায় পুলিশ কেস ছিল ৬৭১ টি। প্রস্তাবিত গোপালপুর জেলায় মোট থানার সংখ্যা ১৩ টি, জনসংখ্যা ১৭,৩৮,৫২৫ জন। আয়তন ২০০৯ বর্গ মাইল। মোট গ্রাম- ২৭২ এবং ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে মোট পুলিশ কেসের সংখ্যা ছিল ১৯৮৪ টি। প্রস্তাবিত জেলার প্রশাসন ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য সরকারী কর্মকর্তা (Civil Executive Staff) ছিল নিম্নরূপঃ ১। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটঃ ০১ জন। ২। মহকুমা প্রশাসকঃ ০১ জন করে প্রতি মহকুমায়। ৩। প্রথম শ্রেণীর ক্ষমতা সম্পন্ন ম্যাজিস্ট্রেট ০২ জন (জেলা সদরের জন্য)। ৪। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও সাব ডেপুটি ম্যাজিস্টেট (২য় শ্রেণী/৩য় শ্রেণীর ক্ষমতা সম্পন্ন) জেলা সদরের জন্য।  ৫। টাঙ্গাইল ও জামালপুর মহকুমার জন্য ২য় শ্রেণী ক্ষমতা সম্পন্ন ২ জন করে সাব ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। ১৯১৩-১৪ খ্রিস্টাব্দে Bengal District Administration Committee টাঙ্গাইল ও জামালপুর, সদর মহকুমা সমন্বয়ে প্রস্তাবিত ‘গোপালপুর জেলার’রূপরেখা ও কাঠামো চুড়ান্ত করার পাশাপাশি জেলা ও মহকুমা সমূহের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রতি নজর রেখেছিলেন। কারণ জলাভূমি, নদ-নদী, উপনদী, খালবিল নালার কারণে তৎকালীন স্থল যোগাযোগ ব্যবস্থা সন্তোষজনক ছিল না। এলাকার উন্নয়ন ও গতিশীল প্রশাসনের জন্য উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা অপরিহার্য এজন্য কমিটি টাঙ্গাইল থেকে ময়মনসিংহ-সিংঝানি এবং যমুনা নদী তীরবর্তী বিখ্যাত বন্দরনগরী সুবর্ণাখালী হতে ময়মনসিংহ, ভৈরব বাজার হতে কিশোরগঞ্জ হয়ে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ও ধারানগিরি কয়লা খনি পর্যন্ত নতুন রেলপথ স্থাপনেরও সুপারিশ করেছিলেন। প্রস্তাবিত গোপালপুর জেলা বাস্তবায়িত হয়নি। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে বৃটেন প্রথম মহাযুদ্ধে জড়িয়ে পরে। ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন ছিল উত্তপ্ত। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বিশ্বযুদ্ধ এবং ভারতীয় উপমহাদেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণেই তৎকালীন বৃটিশ সরকার মিঃ ই.ভি.লিভিঞ্জ কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নে উৎসাহী হয়নি। পরবর্তী কালে জেলা বিভাজন ও নতুন জেলা সৃষ্টির প্রস্তাব ও পরিকল্পনা সরকারী ও স্থানীয় ভাবে একাধিকবার আলোচনায় এসেছে। কিন্তু প্রস্তাবিত ‘গোপালপুর জেলার’কথা রহস্যজনক কারণে অন্ধকারেই থেকে গেছে। প্রস্তাবিত ‘গোপালপুর জেলা’বাস্তবায়িত হলে ময়মনসিংহ জেলার সমগ্র পশ্চিম অঞ্চলের জনগণ অধিক লাভবান হতো। টাঙ্গাইল ও জামালপুর জেলার অবস্থান উত্তর-দক্ষিণ লম্বালম্বি। দু’প্রান্তে দু’টি মহকুমা সদর ও মাঝখানে জেলা সদর প্রতিষ্ঠিত হলে সমগ্র অঞ্চলের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, রাস্তা-ঘাট, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা ও শিক্ষা-সংস্কৃতির ব্যাপক প্রকাশ ঘটতো প্রায় শতবর্ষ পূর্বেই। মিঃ ই.ভি.লিভিঞ্জ কমিটির (১৯১৩-১৪ খ্রিস্টাব্দের) প্রস্তাবিত গোপালপুর জেলা এখন স্থানীয় আঞ্চলিক ইতিহাসে উপাত্ত মাত্র। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষে খেলাফত আন্দোলন শুরু হয়। মওলানা মুহম্মদ আলী ও মওলানা শওকত আলী এই আন্দোলনকে মহাত্নাগান্ধী সমর্থন করেন। ফলে আলী ভ্রাতৃদ্বয়ের খেলাফত আন্দোলন বৃটিশ সাম্রাজ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। খেলাফত আন্দোলনের জন্য টাঙ্গাইলকে জেলা করার পরিকল্পনা স্থগিত হয়ে যায়। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এই সময় বাংলার দুই তৃতীয়াংশ লোক অনাহারে মারা যায়। মানুষ কচু ঘেচু নানারকম অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে অকালে প্রাণ ত্যাগ করতে থাকে।ইংরেজ সরকার দুর্ভিক্ষ রোধ করার জন্য চেষ্টা করেন। বাংলার বাইরে থেকে খাদ্যশস্য এনে জেলাওয়ারী খাদ্যশস্য বণ্টন করে দুর্ভিক্ষ রোধ করার চেষ্টা করা হয়। এই সময় অবিভক্ত বাংলার খাদ্য মন্ত্রী ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেব। টাঙ্গাইলের লোকজন টাঙ্গাইলের জন্য আরো খাদ্য শস্য বরাদ্দের জন্য খাদ্য মন্ত্রীর নিকট দাবি জানায়। শহীদ সাহেব সেই দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই টাঙ্গাইলকে আলাদা একটি জেলায় উন্নীত করার প্রস্তাব করেন। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে পূর্ববাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন টাঙ্গাইল থেকে উপ-নির্বাচনের প্রার্থী হয়েছিলেন। সে সময় মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর অছিয়তে তরুণ অগ্নিবর্ষী নেতা শামছুল হকের নেতৃত্বে টাঙ্গাইলবাসী ১৭ দফা দাবি সম্বলিত এক স্মারক লিপি পেশ করেছিলেন খাজা নাজিমুদ্দিনের কাছে। সেই ১৭ দফার মধ্যে প্রধান ছিল টাঙ্গাইলকে পৃথক জেলায় পরিণত করার দাবী। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগস্ট র‌্যাডক্লিফ সীমানা কমিশন বাংলাকে দু’টি ভাগে বিভক্ত করে। ফলে পূর্ব পাকিস্তান বর্তমান বাংলাদেশের কিছু জেলার সীমানা পরিবর্তন ঘটে। তবে ময়মনসিংহ জেলার সীমানা আগের মত বহাল রাখা হয়। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে উপ-মহাদেশ বিভক্তের পর ময়মনসিংহ জেলাকে ৩ টি জেলায় ভাগ করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। প্রস্তাবিত জেলাগুলোর নাম হলো- নাসিরাবাদ, কায়দাবাদ ও টাঙ্গাইল। এমনকি ময়মনসিংহ জেলার ৫টি মহকুমাকে ৫টি জেলায় বিভক্ত করার প্রস্তাবও করা হয়েছিল। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের পাক-ভারত যুদ্ধের কারণে জেলা স্থাপনের কাজ স্থগিত হওয়ার সুযোগে ১৯৬৬, ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দ তৎকালীন গভর্ণর মোনায়েম খাঁর ভাই খোরশেদ খান সাহেব এক শ্রেণীর কায়েমী স্বার্থন্বেষীদের যোগসাহসে গভর্ণরের আর্শিবাদ পুষ্ট হয়ে জুট মিলের বিনিময়ে জেলার দাবী প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেন। তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে প্রচন্ড রাজনৈতি অস্থিরতা ও সামনে সাধারণ নির্বাচন বিধায় কোনো রাজনৈতিক দলই তখন এদিকটায় তেমন উৎসাহ প্রদর্শন না করার কারণে অবশেষে প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ কর্তৃক স্থাপ্তিত টাঙ্গাইল মাহ্ফিল (স্থাপিত ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ) কর্তৃক অরাজনৈতিক ভাবে জেলা প্রতিষ্ঠার দাবী নিয়ে সোচ্চার হতে হয় এবং ‘টাঙ্গাইল জেলা চাই’ নামে আন্দোলন শুরু করা হয়। মাহ্ফিলে সভাপতি ড. আলীম আল রাজির নেতৃত্বে এই আন্দোলনে মাহফিলকে ড. এম.এন হুদা (সাবেক অর্থমন্ত্রী) তাঁর সরকারী সুবিধা ব্যবহার করে এন.ইসি’র অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি সরবরাহ করে সর্বাত্বক সহযোগিতা দান করেন। টাঙ্গাইলের বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ টাঙ্গাইল থেকে সবিশেষ সক্রিয়তা প্রকাশ করেন। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব-পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচন উপলক্ষে হক-ভাসানী- সোহরাওয়ার্দী যুক্তফ্রন্ট গঠণ করেন। এই সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের কাছে মুসলিম লীগ সূচনীয় ভাবে পরাজিত হয়। যুক্তফ্রন্টের কাছে টাঙ্গাইল বাসী টাঙ্গাইলকে পৃথক জেলা ঘোষণা করার দাবি জানায়। যুক্তফ্রন্ট তা নির্বাচনী ওয়াদা হিসাবে অন্তর্ভূক্ত করে। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করে। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনী ওয়াদা হিসেবে টাঙ্গাইলকে পৃথক জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম শুরু করে। এ ব্যাপারে মওলানা ভাসানীর সক্রিয় সমর্থন ছিল। ১৯৩৮, ১৯৪৩, ১৯৪৮, ১৯৫৪ ও ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে প্রাদেশিক সরকারের বিভিন্ন মূখ্যমন্ত্রী ও বিভাগীয় মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে যুক্তিক দাবী দাওয়া উত্থাপন ও সরকারী পর্যায়ে সমর্থিত হবার এক পর্যায়ে ১৯৬০, ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান অর্থনৈতিক কাউন্সিল মোমেনশাহীকে ভেঙ্গে টাঙ্গাইল, কাইদাবাদ ও নাসিরাবাদ জেলা করার চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত অনুমোদন করে। টাঙ্গাইল মহকুমা প্রতিষ্ঠার একশত বৎসর পর অর্থাৎ ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১ডিসেম্বর টাঙ্গাইল মহকুমা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের তথা বাংলাদেশের ১৯তম জেলা হিসেবে আত্নপ্রকাশ করে।


০২

টাঙ্গাইল জেলার নামকরণ

টাঙ্গাইলের নামকরণ বিষয়ে বহুজনশ্রুতি ও নানা মতামত রয়েছে । ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত রেনেল তাঁর মানচিত্রে এ সম্পূর্ণ অঞ্চলকেই আটিয়া বলে দেখিয়েছেন। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দের আগে টাঙ্গাইল নামে কোনো স্বতন্ত্র স্থানের পরিচয় পাওয়া যায় না। টাঙ্গাইল নামটি পরিচিতি লাভ করে ১৫ নভেম্বর ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে মহকুমা সদর দপ্তর আটিয়া থেকে টাঙ্গাইলে স্থানান্তরের সময় থেকে।

টাঙ্গাইলের ইতিহাস প্রণেতা খন্দকার আব্দুর রহিম সাহেবের মতে, ইংরেজ আমলে এদেশের লোকেরা উচু শব্দের পরিবর্তে ‘টান’শব্দই ব্যবহার করতে অভ্যস্ত ছিল বেশি। এখনো টাঙ্গাইল অঞ্চলে ‘টান’ শব্দের প্রচলন আছে। এই টানের সাথে আইল শব্দটি যুক্ত হয়ে হয়েছিল টান আইল। আর সেই টান আইলটি রূপান্তরিত হয়েছে টাঙ্গাইলে। আরেক জনশ্রুতি মতে, বৃটিশ শাসনের প্রায় প্রারম্ভে আকুরটাকুর ও শাহবালিয়া মৌজার মধ্যবর্তী এলাকায় টেংগু সাহেবের নীল চাষ ও নীলের কারখানা ছিল। পূর্বোক্ত দুই মৌজার সীমানা বরাবর তিনি উচু মেটোপথ বা আইল যাতায়াতের জন্য তৈরী করেছিলেন। সাধারণ জনগন এই আইলকে টেংগু সাহেবের আইল বলে উল্লেখ করতো। সুতরাং অনুমান করা হয় যে, টাঙ্গাইল শব্দটি টেংগু সাহেবের আইল নামেরই অপভ্রংশ। তরুণ গবেষক ইতিহাসবিদ, অনুবাদক জনাব খুররম হোসাইন তার ‘টাঙ্গাইলের স্থান নামঃ ইতিহাস ও কিংবদন্তী’নামক এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন যে, সুবাদার শায়েস্তাখান তাঁর আমলে জলদস্যুদের মোকাবেলা করার জন্য দক্ষিণ ভারতের মালাবর অঞ্চলের মোপলাদের নিয়ে জান রংরুটে। জলদস্যুদের উৎপাত যখন কিছুটা দমিত হলো তখন তাদের বসতির স্থান নির্ধারণ করলেন বর্তমান টাঙ্গাইল শহরের পশ্চিম প্রান্তে। মোপলাদের ধর্মগুরুকে তারা নিজস্ব ভাষায় তাংগাইল বলতো। অর্থাৎ মোপলাদের সর্দারকে যে স্থানে জায়গা দেয়া হয়েছিল সেই স্থানটিই ক্রমে টাঙ্গাইল নামে পরিচিত হতে থাকে। টাঙ্গাইল জেলা গেজেটিয়ার ও বাংলাদেশ আদম শুমারী রিপোর্টে নামকরণ বিষয়ে সর্বাগ্রে এ তথ্যটি উল্লেখ করা হয়েছে এবং ডঃ তারা চাঁদের "The influence of Islam on Indian culture"- গ্রন্থেও এ বিষয়ে সাক্ষ্য মেলে।

টাঙ্গাইলের নামকরণ নিয়ে আরো অনেকে বিভিন্ন সময়ে নানা মত প্রকাশ করেছেন। কারো কারো মতে, বৃটিশ শাসনামলে মোগল প্রশাসন কেন্দ্র আটিয়াকে আশ্রয় করে এই অঞ্চল জমজমাট হয়ে উঠেছিল। সে সময়ে ঘোড়ার গাড়ি ছিল যাতায়াতের একমাত্র বাহন, যাকে স্থানীয় লোকেরা বলত ‘টাঙ্গা’। বর্তমান শতকের মাঝামাঝি পর্যন্তও এ অঞ্চলের টাঙ্গা গাড়ির চলাচল ছিল সর্বত্র। আল শব্দটির কথা এ প্রসঙ্গে চলে আসে। আল শব্দটির অর্থ সম্ভবত সীমা নির্দেশক যার স্থানীয় উচ্চারণ আইল। একটি স্থানকে যে সীমানা দিয়ে বাঁধা হয় তাকেই আইল বলা হয়। টাঙ্গাওয়ালাদের বাসস্থানের সীমানাকে ‘টাঙ্গা+আইল’এভাবে যোগ করে হয়েছে ‘টাঙ্গাইল’।

ইতিহাসবিদ মুফাখখারুল ইসলামের মতে, কাগমারি পরগণার জমিদার ইনাযাতুল্লাহ খাঁ চৌধুরী (১৭০৭-১৭২৭ খ্রিস্টাব্দ) লৌহজং নদীর টানের আইল দিয়ে কাগমারির আধামাইল দূরে খুশনুদপুর (খুশির জায়গা যার সংস্কৃতায়ন করলে সন্তোষ) তাঁর সদর কাচারিতে যাতায়াতে করতেন। এই টানের আইল বা টান আইল দীর্ঘদিন ধরে উচ্চারিত হতে হতে টাঙ্গাইল নামকরণ হয়েছে। অন্য মতবাদে জানা যায় ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে সরকারের আদেশ অনুযায়ী পারদীঘুলিয়া মৌজার অন্তর্গত আতিয়া নামক গ্রামে টান-আইল থানার সদর স্থাপন করা হয়। গত শতাব্দীর মধ্যবর্তীকালীণ সময়ে টান-আইল মৌজা টাঙ্গাইল নামের রূপান্তরিত হয়।

অন্য একটি মতবাদ অনুযায়ী, আইল শব্দটি কৃষিজমির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই শব্দটি আঞ্চলিক ভাবে বহুল ব্যবহৃত শব্দ। টাঙ্গাইলের ভূ-প্রকৃতি অনুসারে স্বাভাবিকভাবে এর ভূমি উঁচু এবং ঢালু। স্থানীয়ভাবে যার সমার্থক শব্দ হলো টান। তাই এই ভূমিরূপের কারণেই এ অঞ্চলকে হয়তো পূর্বে ‘টান আইল’বলা হতো। যা পরিবর্তীত হয়ে টাঙ্গাইল হয়েছে। অন্য একটা সূত্রে জানা যায় হযরত শাহ জামাল (রাঃ) জাহাজ যোগে এদেশে আগমন করার সময় মাদ্রাজ থেকে একদল জেলে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। এদের দলপতির নাম ‘টাংগা’। জেলেরা লৌহজং নদীর পূর্ব তীরে বসবাস শুরু করে। তাদের দলপতির নামানুসারে স্থানের নাম হয় ‘টাঙ্গাইল’। আর একটি মতবাদ হচ্ছে , অতীতে এখানকার মানুষ বসবাসের জন্য মাটির উপর বাঁশ পুঁতে টং ঘর নির্মাণ করতো। টং ফরাসী শব্দ, অর্থ হলো উঁচু। সে সময়ে স্থানীয় অনার্য বাসিন্দারা বাসস্থানকে ‘ইল’ বলতো। তাই কারো কারো মতে এই টংইল (উঁচু বাসস্থান) থেকে টাঙ্গাইল নামের উৎপত্তি। আবার কথিত আছে জনৈক ইংরেজ সন্তোষ জমিদারিতে ব্রিটিশ আমলে রাজস্ব আদায় করতে এসেছিলেন। রাজস্ব আদায় শেষে ঢাকা যাওয়ার পথে একদল ঠগ রাজস্বের অর্থ লুটপাট করে সেই সঙ্গে ইংরেজ সাহেবকে হত্যা করে লৌহজং এর পূর্ব পারে টাংগিয়ে রেখে যায়। সেই থেকে নাম দেওয়া হয়েছে টাঙ্গাইল। আবার কারো করো মতে ‘টান’ এবং ‘ইল’ নামক দু’জন ইংরেজ সাহেব সন্তোষ জমিদারিতে এসেছিলেন থানার স্থান নির্বাচনের জন্য তাদের নামানুসারে নাম হয়েছে টাঙ্গাইল। টাঙ্গাইলের বিভিন্ন স্থানের নামে ‘আইল’ শব্দের আধিক্য আছে (যেমন- বাসাইল, ঘাটাইল, ডুবাইল, নিকরাইল, রামাইল ইত্যাদি) অনেকের ধারণা টাঙ্গাইলের অন্য স্থানের নামের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ঘটনা প্রবাহে ‘টাঙ্গাইল’ নাম হয়েছে।

টাঙ্গাইল জেলার নামকরণের ইতিহাস পর্যালোচনা করে বোঝা যাচ্ছে , টাঙ্গাইলের ইতিহাস ও এর নামকরণের মতই বিচিত্র।


০৩

ভৌগোলিক অবস্থান

টাঙ্গাইল জেলা ২৩­৫৯”৫০' উত্তর অক্ষাংশ থেকে ২৪­৪৮”৫১' উত্তর অক্ষাংশ ও ৮৯­৪৮”৫০’ পূর্ব দ্রাঘিমা থেকে ৯০­৫১”২৫’পূর্ব দ্রাঘিমা পর্যন্ত।

০৪

আয়তন

৩৪১৩.৬৮ বর্গ কি: মি:।

০৫

সীমানা

উত্তরে জামালপুর জেলা, দক্ষিণে ঢাকা জেলা ও মানিকগঞ্জ জেলা, পূর্বে ময়মনসিংহ জেলা ও গাজীপুর জেলা, পশ্চিমে সিরাজগঞ্জ জেলা।

০৬

ভূপ্রকৃতি

বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার ভৌগোলিক অবস্থান মধুপুর অঞ্চলের উচ্চ মালভূমির দক্ষিণে যমুনা নদীর নিকটবর্তী একটি নিচু প্লাবনভূমি দ্বারা চিহ্নিত। জেলাটির আয়তন ৩,৩৭৫ বর্গ কিলোমিটার এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে গড় উচ্চতা ১৪ মিটার। জেলাটি ১২ টি উপজেলায় বিভক্ত, যা আরও ১২০ টি ইউনিয়ন পরিষদ এবং ২,৫১৬ টি গ্রামে বিভক্ত। জেলার প্রধান নদীগুলো হলো যমুনা, ধলেশ্বরী, ঝিনাই, বংশী, লৌহজং, লাঙ্গুলিয়া, এলোংজানি, জুগনি, পৌলি, ফটিকজানি ও তুরাগ। জেলাটিতে উষ্ণ এবং আর্দ্র গ্রীষ্ম এবং হালকা শীতের সাথে একটি গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ু রয়েছে। গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাত প্রায় ২০০০ মিলিমিটার। জেলাটি প্রধানত ধান, পাট, আখ, গম, সরিষা এবং শাকসবজি প্রধান ফসল হিসাবে একটি কৃষি ক্ষেত্র। জেলাটি তাঁত শিল্প ও টাঙ্গাইল শাড়ি এবং চমচমের জন্যও বিখ্যাত।

০৭

জলবায়ু

উষ্ণ এবং আর্দ্র গ্রীষ্ম এবং হালকা শীতের সাথে একটি গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ু

০৮

জীববৈচিত্র

বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্যময়, কারণ এতে বিভিন্ন ধরনের বাস্তুতন্ত্র, আবাসস্থল এবং প্রজাতি রয়েছে। জেলায় শাল বনের একটি বিশাল এলাকা রয়েছে, যা দেশের অন্যতম সেরা, সেইসাথে জলাভূমি, তৃণভূমি এবং কৃষি জমি রয়েছে। জেলাটিতে অনেক গাছপালা এবং প্রাণী রয়েছে, যার মধ্যে কিছু স্থানীয়, বিরল বা বিপন্ন।

রহমান এট আল-এর একটি গবেষণা অনুসারে (২০১৯), টাঙ্গাইল জেলায় অবস্থিত মধুপুর জাতীয় উদ্যানে ১৭৬ টি উদ্ভিদ প্রজাতি রয়েছে, যার মধ্যে ৭৩ টি গাছের প্রজাতি, ২২ টি ঝোপের প্রজাতি, ২৭টি লতা, ৪৫ টি ঔষধি গাছ, ৮ টি ঘাস এবং ১ টি পাম প্রজাতি রয়েছে। পার্কের প্রভাবশালী গাছের প্রজাতি হল সাল (শোরিয়া রোবাস্টা), কদম (অ্যান্টোসেফালাস চিনেনসিস), কোরোই (আলবিজিয়া প্রসেরা), এবং জাম (সিজিজিয়াম কুমিনি)। পার্কটিতে অনেক অর্কিড, ফার্ন, লাইকেন এবং শ্যাওলা রয়েছে। উদ্যানের কিছু উল্লেখযোগ্য উদ্ভিদ প্রজাতি হল চন্দন (স্যান্টালম অ্যালবাম), সুন্দরী (হেরিটিয়ারা ফোমস), কুর্চি (হোলারহেনা অ্যান্টিডিসেন্টেরিকা), এবং অশ্বগন্ধা (উইথানিয়া সোমনিফেরা)।

টাঙ্গাইল জেলার প্রাণিকুল ১৯০ টি প্রজাতি নিয়ে গঠিত যার মধ্যে ২১ টি স্তন্যপায়ী প্রাণী, ১৪০ টি পাখি এবং ২৯ টি সাপ রয়েছে। স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে রয়েছে দাগযুক্ত হরিণ (অক্ষ অক্ষ), বার্কিং ডিয়ার (মুন্টিয়াকস মুন্টজাক), বন্য শুয়োর (সুস স্ক্রোফা), রিসাস ম্যাকাক (ম্যাকাকা মুলতা), শেয়াল (ক্যানিস অরিয়াস), মঙ্গুজ (হার্পেস্টেস এডওয়ার্ডসি), এবং প্যাঙ্গোলিন (মানিস ক্রাসিকাউডাটা)। পাখির মধ্যে রয়েছে ময়ূর (পাভো ক্রিস্ট্যাটাস), প্যারাকিট (পসিটাকুলা এসপিপি), কিংফিশার (আলসেডো এসপিপি), কাঠঠোকরা (ডেনড্রোকোপোস এসপিপি), হর্নবিল (বুসেরোস বাইকর্নিস), এবং ঈগল (অ্যাকিলা এসপিপি)। সাপের মধ্যে রয়েছে কোবরা (নাজা নাজা), অজগর (পাইথন মোলুরাস), ক্রাইট (বুঙ্গারাস এসপিপি), এবং ইঁদুরের সাপ (পত্যাস মিউকোসা)।

টাঙ্গাইল জেলার জীববৈচিত্র মানবিক কর্মকাণ্ড যেমন বন উজাড়, চোরাচালান, দখল, অত্যধিক চারণ, দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনেক হুমকির সম্মুখীন। জেলাটির প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা এবং পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার জন্য জরুরি সংরক্ষণ ব্যবস্থা প্রয়োজন। সম্ভাব্য কিছু পদক্ষেপ হল স্থানীয় জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা, আইন ও প্রবিধান প্রয়োগ করা, সুরক্ষিত এলাকা এবং করিডোর প্রতিষ্ঠা করা, টেকসই জীবিকা ও ইকোট্যুরিজমের প্রচার করা, অবনতিশীল আবাসস্থল পুনরুদ্ধার করা এবং জীববৈচিত্র্যের অবস্থা পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা করা।

০৯

প্রশাসনিক তথ্য

টাঙ্গাইল জেলা বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত যা ঢাকা বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল।

১০

জনসংখ্যা

৪০,৩৬,৩৩৩ জন

পুরুষ-২৩,০৫,০০২ জন

মহিলা-২০,৯০,৯৮২ জন

মুসলমান- ৯৩.১৭%

খ্রিষ্টান- ০.৩৮%

হিন্দু- ৬.৩৬%

বৌদ্ধ- ০.০১%

অন্যান্য- ০.০৯% জন।

১১

স্বাক্ষরতার হার

৬৯.৬২%